== রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায় ‘‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’’র প্রেসিডেন্ট শওকত হাসান মিয়ার উত্থানকাহিনী। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে নুন আনতে পানতা ফুরোয় অবস্থা থাকলেও তিনি এখন শত শতকোটি টাকার মালিক। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রয়েছে বিস্তর সম্পত্তি।
কুমিল্লা সেনানিবাসে জনৈক মেজরের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত শওকত মিয়া এখন থাকেন আলিশান বহুতল ভবনে, হাঁকিয়ে বেড়ান বিলাসবহুল গাড়ি। কেতাদুরস্ত পোশাক পরে চলেন সমাজের উঁচুতলার মানুষের সঙ্গে। থাকেন দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, কোন আলাদিনের চেরাগের বদৌলতে মাত্র কয় বছরে হয়ে গেলেন এত বিত্তবৈভবের মালিক?
১৯৭৭ সালে এক কর্নেলের সুপারিশে শওকত আলী সেনাবাহিনীর ৩৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী (নম্বর-৩৯৬৯৮১০) পদে চাকরি পান। যদিও চাকরিটি পেতে পঞ্চম শ্রেণি পড়য়া শওকতকে অষ্টম শ্রেণির জালসনদ জোগাড় করতে পোহাতে হয়েছিল বহু কাঠখড়। গুরুতর এক অভিযোগে ১৯৮৩ সালের ১৯ জুন সেনা কোর্টমার্শালের বিচারে চাকরিচ্যুত হন।
আর এতেই যেন শাপে বর হয় তার। বাইরে এসেই চাকরিচ্যুত শওকত বনে যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর। ভুয়া এই পরিচয় জাহির করে তিনি চট্টগ্রামে বাঁশ ব্যবসার অন্তরালে জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের চোরাই কাঠ পাচার সিন্ডিকেটে। গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয়ে পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। সেই চেরাগ ঘষেই হতদরিদ্র শওকত আজ শত-সহস্র কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে অ্যাসার্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান। রাজধানীর গুলশান-বারিধারার প্রগতি সরণি সংলগ্ন বহুতল ভবন জামালপুর টুইন টাওয়ারটি তার। ঢাকা ও জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্লট-ফ্ল্যাট ছাড়াও জমি কিনে গড়ে তুলেছেন একাধিক সুউচ্চ ভবন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঐতিহ্যবাহী লীগ নামটি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন তথাকথিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ। বনে গেছেন এর প্রেসিডেন্ট। এই দলকে ঘিরেও শুরু করেন অভিনব চাঁদাবাজি। অথচ ইসিতে বর্তমানে নিবন্ধিত ৪১টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেই এই দলের নাম!দলটির একাধিক নেতাওজানিয়েছেন বঙ্গলীগ নামে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অনুমোদিত কোনো অঙ্গসংগঠন নেই বলে ।
প্রতারণা ছাড়াও জামালপুরের নিরীহ গ্রামবাসীর জমি জবরদখলের অভিযোগও রয়েছে শওকতের বিরুদ্ধে। মেজরের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট শওকত হাসান শুধু যে অন্যের জমি জবরদখল করেছেন তা নয়, ডেসকোর বিদ্যুৎ সংযোগও নিয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর ধরে জ্বালিয়েছেন সুউচ্চ ভবনে অবৈধ গ্যাস সংযোগও। যদিও এ চৌর্যবৃত্তির দায়ে তাকে জরিমানা গুনতে হয়েছিল কয়েক লাখ টাকা।
সুচতুর শওকত শুধু সরকারের সঙ্গেই প্রতারণা করেননি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি ধর্মীয় উপাসনালয়ও। সদলবলে বিশাল বহর নিয়ে শোডাউন করে বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় গিয়ে লাখ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেন না। দেন না কোনো অর্থ!
পেশিশক্তির বলে নিরীহ অনেকের জমি জবরদখল, প্রতারণাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে অতিষ্ঠ হয়ে শওকত হাসানের বিরুদ্ধে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের কয়েকটি দপ্তরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন গ্রামবাসী। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (আইন-৩ অধিশাখা) তৎকালীন উপসচিব মো. খায়রুল আলম সেখ এক চিঠির মাধ্যমে ভুয়া মেজর (অব.) শওকত হাসান মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জামালপুরের পুলিশ সুপারকে (এসপি) দ্বিতীয় দফায় নির্দেশক্রমে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে তিনি দাবি করেন অর্ধশত কোটি টাকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের (ইউআইটিএস) উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে ফেঁসে গেছেন ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’র প্রেসিডেন্ট শওকত।
এই চাঁদা দাবির ঘটনায় করা মামলায় বর্তমানে তিনি কারাগারে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (১১ নম্বর কোর্ট) নির্দেশে গত ২৭ জুলাই থেকে শওকত কারান্তরীণ। এদিকে শওকতের গ্রেপ্তারের খবরে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে ভুক্তভোগীরা।
অন্যদিকে শওকত হাসান কীভাবে এত বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তা সঠিক তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে শওকতের বরাবর সম্পত্তির বিবরণ প্রদানের নোটিশ দিয়েছে। অভিযোগ দুদকের অধীনে বর্তমানে তদন্তাধীন। অনুসন্ধানেও এ ব্যাপারে মিলেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট শওকত মিয়া বর্তমানে কারাগারে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার মনোনীত দুই আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম ও বিউটি আক্তারের কাছে মামলার শেষ অবস্থার কথা জানতে চাইলে বলেন, এ মামলা এখন আর তারা দেখছেন না। ফলে শেষ আপডেটের বিষয় অবগত নন।
শওকতের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে দাখিল করা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সূত্র ছাড়াও জামালপুরের ইসলামপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শওকত হাসানের বাবার নাম মোজাম্মেল হক মিয়া (মৃত)। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলাধীন কুলকান্দি ইউনিয়নে। তার মা সিরিয়া খাতুন বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির আওতায় ইসলামপুরের ৭ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের ‘দুস্থ মাতা কার্ডধারী বিধবা’ তালিকাভুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধের আগে যমুনার ভাঙনে নদীগর্ভে ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার পর শওকতের বাবা জামালপুরের কুলকান্দি এলাকায় মাগুন মিয়া বাজারে ভিক্ষা করতেন। দানের টাকায় সচল রেখেছিলেন সংসারের চাকা। অন্যের বাড়িতে কাজ করে চার সন্তানের মুখে দু-বেলা খাবার তুলে দিতে কষ্ট হতো মা ও হতদরিদ্র বাবার। শওকত হাসান নিজেও কুমিল্লা সেনানিবাসের এক মেজরের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
ওই বাসা থেকে বিতাড়িত হওয়ার কিছুদিন পর জনৈক এক কর্নেলের সহযোগিতা পান। তার সুপারিশে ১৯৭৭ সালে অষ্টম শ্রেণির জাল সনদ দিয়ে সেনাবাহিনীর ৩৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী পদে চাকরি পান শওকত। চাকরি পাওয়ার পর কুমিল্লার দেবীদ্বার থানায় কর্মরত পুলিশের এক এসআইয়ের কন্যাকে ভাগিয়ে বিয়ে করেন ।
এ ঘটনা ১৯৮০ সালের। ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান হওয়ার পর উধাও হয়ে যান। প্রায় দুই বছর ধরে ছিলেন লাপাত্তা। এদিকে পালিয়ে বিয়ে করায় ঘরে উঠতে পারছিলেন না স্ত্রী। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোলের সন্তানকে নিয়ে শওকতের চট্টগ্রামের কর্মস্থলে হাজির হন তিনি। স্বামীর সহকর্মীদের কাছে জানতে পারেন চট্টগ্রামের এক মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
উপায়ান্তর না পেয়ে প্রথম স্ত্রী চট্টগ্রামের কাপ্তাই সেনাক্যাম্পের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে শওকতের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। অভিযোগে সত্যতা পেয়ে ১৯৮৩ সালের ১৯ জুন সেনা কোর্টমার্শালের বিচারে চাকরিচ্যুত করা হয় সিপাহী শওকতকে। এরপর সেই শওকত বনে যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর!!