== বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আরাবর হত্যা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পুরো বুয়েটই খুন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, প্রাধ্যক্ষ, ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক, বুয়েটে অবস্থানরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আবরারের খুন ঠেকাতে পারেননি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তাকে সেদিন রাতে শেরেবাংলা হলে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে হলের ভেতরে ঢুকতে দেননি। রাষ্ট্রের আইন সেখানে খাটে না। ছাত্রলীগের কথাই আইন। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত কেউ ছাড় পাবেন না। অপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান তাঁদের এ বক্তব্য সমর্থন করে না।
স্বাধীনতার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন করে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হন।
আগের কথা যদি বাদও দিই, আওয়ামী লীগের টানা গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুন হন, যার মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীই বেশি। কিন্তু একটিরও বিচার হয়নি। বিচার হলেও কেউ শাস্তি পাননি। আসামিদের কেউ কেউ পলাতক অথবা বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ক্যাম্পাসে খুনের রাজনীতি কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা সরকারবিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠন শুরু করেনি। বড় দাগে এই খুনের রাজনীতি চালু করে ছাত্রলীগেরই একাংশ ১৯৭৪ সালে। তারও আগে ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে জাসদ–সমর্থিত ছাত্রলীগের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন।
ওই নির্বাচনে ভরাডুবি হবে জেনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ। যদিও তখন জাসদ ছাত্রলীগের ওপরই এর দায় চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল। বাংলাদেশে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির সর্বনাশ শুরু হয় তখন থেকেই।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য মস্কো যান। ৪ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা সূর্য সেন হলের ৬৩৫ নম্বর কক্ষ থেকে ছাত্রলীগের নেতা কোহিনুরসহ চারজনকে হ্যান্ডস আপ করিয়ে নিয়ে আসেন মুহসীন হলের টিভিরুমের সামনে।
অস্ত্রধারীদের আরেকটি দল ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে আরও তিনজনকে একই কায়দায় সেখানে নিয়ে আসেন। রাত ২টা ১১ মিনিটে ওই সাতজন ছাত্রকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন তাঁরা। এরপর অস্ত্রধারীরা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
মুহসীন হলে যাঁরা খুন হলেন এবং যাঁরা খুন করলেন, তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের। নিহত শিক্ষার্থীরা আওয়ামী যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সমর্থক ছিলেন। প্রতিপক্ষ গুরুপের উসকানিতে শফিউল আলম প্রধান এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। পরদিন হত্যার বিচারের দাবিতে যে মিছিল হয়, তাতেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিন দিন পর প্রধান গ্রেপ্তার হন। হত্যাকারীদের মধ্যে যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁদের বর্ণনায় উঠে আসে খুনের ভয়ংকর বিবরণ।
আওয়ামী লীগ শাসনামলেই মুহসীন হলের সাত হত্যার বিচার হয়। বিচারে প্রধানের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাঁকে ১৯৭৮ সালে মুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে মাঠে নামান। এরপর ক্যাম্পাসে শুরু হয় ছাত্রদলের তাণ্ডব। মেধাবী ছাত্রদের জিয়া হিজবুল বাহারে নিয়ে গিয়ে কী তালিম দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু গোলাম ফারুক অভিসহ অনেক মেধাবী ছাত্রই সন্ত্রাসীতে পরিণত হন।
ক্যাম্পাসে খুনোখুনির ঘটনা সব সরকারের আমলেই হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন বাবলুসহ আরও অনেকে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলের সন্ত্রাস ও হানাহানি এতটাই বেড়ে যায় যে সরকার নাসিরউদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টুকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। পিন্টু তখন দলের সাংসদ ও ছাত্রদলের সভাপতি।
২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন আবুবকর নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ছিলেন এক দিনমজুরের সন্তান।
এ ঘটনায় এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ। কিন্তু মামলার রায়ে ২০১৭ সালের ৭ মে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা–কর্মীর প্রত্যেককে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। ওই রায়ের পর পত্রিকায় সংবাদ হয়েছিল আবু বকরকে কেউ খুন করেনি। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে শিবির কর্মীদের হাতে খুন হন ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক। লাশ পড়ে থাকে ম্যানহোলের ভেতরে। একই কায়দায় লতিফ হলের ডাইনিংয়ের পাশের ড্রেনে পাওয়া যায় লিপু নামের ছাত্রলীগের আরেক কর্মীর লাশ। কোনোটির বিচার হয়নি। ফারুক হত্যায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিলেও লিপু হত্যার তদন্তই শেষ হয়নি। সরকারের শিবিরবিরোধী রাজনীতির নমুনা।
২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্যাতনে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ নিহত হন। তিনিও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গুরুপের কর্মী ছিলেন। ছয় বছর পর হাইকোর্ট অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগের কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সেই রায় কার্যকর হয়নি।
আমরা যদি আরেকটু পেছনে তাকাই দেখতে পাব, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল করছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মঈন হোসাইন ওরফে রাজু ও তাঁর বন্ধুরা। সেই মিছিলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে রাজু খুন হলেও পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি।
বিগত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো ২০১৬ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা। লাশ উদ্ধারের তিন দিন পর ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেলের চিকিৎসকদের দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে দিয়াজের মা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপুসহ ছাত্রলীগের ১০ নেতা–কর্মীকে আসামি করা হয়।
দিয়াজের মায়ের আপত্তিতে আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই এক প্রতিবেদনে চিকিৎসকেরা দিয়াজের শরীরে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানান। বর্তমানে মামলাটি পিআইবির তদন্তাধীন। দিয়াজের মা সন্তান হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু তদন্তকাজ শেষ হয় না।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে খুনোখুনি করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে ছাত্রলীগও একই কাজ করে। আসল রোগ ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল নয়। আসল রোগ হলো ক্ষমতা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবা। আবরার ফাহাদ হত্যার বিচার হবে কি হবে না, সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে ক্যাম্পাসে সংঘটিত ১৫০টি খুনের বিচার না হলেও ১৫১তম খুনটির বিচার হবে। অপরাধীরা শাস্তি পাবেন। কিন্তু তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ভয়াবহ নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি চলছে, তার অবসান আশা করা যায় না।
আবরারের খুনের কারণ হিসেবে কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ রুদ্ধ করা ও র্যাগিং সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, এই ব্যাধির শিকড় আরও গভীরে। কোনো কিছুকে পরোয়া না করা কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে বিদ্যমান, এ হত্যা তারই বহিঃপ্রকাশ।
যাঁরা আবরারকে ছয়–সাত ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন, তাঁরা ধরে নিয়েছেন তাঁদের কিছু হবে না। কেননা তাঁদের দল ক্ষমতায় আছে। বিএনপির আমলে ছাত্রদলও এ রকম ভাবত। আইন নিজের হাতে নেওয়া কিংবা দায়মুক্তির সংস্কৃতি মানুষকে এতটাই অমানুষ করে যে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
ছাত্ররাজনীতির নামে এই অপরাজনীতি উচ্চশিক্ষালয়ে আসা শিক্ষার্থীকে শুধু লাশ করে না, খুনিও করে। আবরারের মা–বাবা কখনো ভাবেননি তাঁদের সন্তান লাশ হয়ে ফিরে যাবেন। কিন্তু তিনি লাশ হয়েই ফিরে গেলেন। একইভাবে যাঁরা আবরারকে খুন করেছেন, তাঁদের মা–বাবাও সন্তানকে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছিলেন মানুষ হতে। তাঁরা কখনো ভাবেননি, তাঁদের সন্তান খুনি হবেন। অথচ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি তাঁদের শেষ পর্যন্ত খুনিতেই রূপান্তরিত করল।