মঙ্গলবার১১ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ১১ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি২৬শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বনাশা অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার

দেশের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীদের টার্গেট করে পাশেই ঘরে উঠেছে নামে বেনামে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের জিম্মি করে চলছে রমরমা টেস্ট বাণিজ্য।অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে মোটা অঙ্কের কমিশন পান দালালরা। শুধু ঢাকা মেডিকেল কেন্দ্রিকই নয়, রাজধানীর বড় সব সরকারি হাসপাতাল ঘিরেই এমন ভুইফোঁড় ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে এনে এসব প্রতিষ্ঠানে ফাঁদে ফেলা হয়। এতে সর্বস্বাস্ত হচ্ছেন সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনরা। এমনকি ভুল রিপোর্ট, ভুয়া চিকিৎসায় সর্বনাশ হচ্ছে অনেক রোগীর। এসব প্রতিষ্ঠানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর  তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কার্যক্রমে ঝুঁকির মুখে পড়ছে স্বাস্থ্যসেবা।  চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিলে সেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাসপাতালে থাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকজন রোগীর স্বজনদের নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকেন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এইসব মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করান।

সরজমিন মেলেছে এসব অভিযোগের সত্যতা। সরকারি হাসপাতালের ২০০ গজের মধ্যে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার রাখা যাবে না এমন নির্দেশনা থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের হাতে পুরোপুরি আইনপ্রয়োগ করার ক্ষমতা না থাকায় অভিযোগ আসা সত্ত্বেও তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। ওদিকে সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে দেখা যায়, ওই এলাকায় অথেন্টিক ডায়াগনস্টিক, অ্যাকটিভ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রিলায়েন্স ডায়াগনস্টিক, ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অ্যাডভান্স হেলথ এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত দালালরা রোগী নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল থেকে। পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক লিমিটেড থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হচ্ছিলেন হাফসা আক্তার নামের এক রোগী। মদনপুর থেকে পেটে সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। টেস্ট করার জন্য ঢাকা মেডিকেলের দ্বিতীয় তলায় গেলে সেখানে শফিক নামে এক দালাল তাকে ২০০ টাকায় টেস্ট করিয়ে দিবে বলে নিয়ে যায় পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিকে। টেস্ট করানোর পর তার হাতে এক হাজার টাকার বিলের রসিদ ধরিয়ে দেয়া হয়। অনেক কথা কাটাকাটির পর বাধ্য হয়ে ৮০০ টাকা দিতে হয়েছে তাকে। টাকা তো দিয়েছেন সঙ্গে মোবাইল ফোনটাও হারিয়ে ফেলেছেন

। তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ টাকা নেই বিধায় ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। ঢাকা মেডিকেলে যে টেস্ট করালে ২০০ টাকা লাগতো সেই টেস্ট এখানে তার কাছ থেকে ৮০০ টাকা নিয়েছে। কিছু কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তারের সিলযুক্ত প্যাড ব্যাবহার করছে। ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাদের প্যাডে প্রফেসর ডা. এসকে বাউলের সিল ব্যবহার করে রোগীদের রিপোর্ট দিচ্ছে।

ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরজমিন দেখা গেছে এই চিকিৎসক ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসেন না। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শিপন নামে শুধুমাত্র একজন রেডিওলজিস্ট রয়েছে। তাকে দিয়ে এইখানে বসা ডেন্টিস্টদের সহকারীর কাজও করানো হয়। ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক আমিনুল ইসলামের কাছে এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সে কোন কোন টেকনিশিয়ানদের নাম উল্লেখ করা আছে তা জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ছাড়া লাইসেন্স দেখাতে পারেননি। বলেন, এখানে রেডিওলজি বিভাগে আশরাফুল ইসলাম মুজাহিদ কাজ করেন। কিন্তু দেখা যায় এখানে মুজাহিদ দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও রেডিওলোজিতে কাজ করেন শিপন। রেডিওলজিস্ট শিপন স্বীকার করে বলেন, এখানে আমি একাই কাজ করি অন্য কেউ কাজ করে না। চিকিৎসক এসকে বাউলকে কখনো বসতে দেখেননি বলে ওই ক্লিনিকের এক কর্মী জানিয়েছেন। এই ভবনেই আরেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার নাম পিওর হলেও কাজে পুরোটাই ভেজাল, ঢাকা মেডিকেলে আসা দরিদ্র রোগীদের দালালের মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে টেস্ট করানোর জন্য এখানে নিয়ে আসেন তারা।

শুরুতে রোগীদের কম মূল্যে পরীক্ষা করানোর কথা বললেও পরে তাদের হাতে অধিক মূল্যের রসিদ ধরিয়ে দেয়। এছাড়া তাদের এক্সরে মেশিন ও টেকনিশিয়ান নেই কেউ এক্সরে করতে আসলে তারা ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এক্সরে মেশিন ও টেকনিশিয়ানদের দিয়ে এক্সরে করেন। যেখানে খোদ ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রয়েছে মানহীন মেশিন ও অদক্ষ টেকনিশিয়ান।

পিওর সায়েন্টিফিক  ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডের  এক কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেন, এখানে আমাদের টেকনিশিয়ান না থাকায় ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এক্সরে করছি, আমরা জানি যে তাদের লাইসেন্স নেই। এ ভবনে প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসা বেশির ভাগ রোগী হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের।