বাংলা সংবাদ২৪ ডেস্ক:– ব্র্যাক ট্রেনিং এন্ড রিসোর্স সেন্টারে ক্লাস নিচ্ছিলাম বেসরকারি হাই স্কুলের টিচারদের, শ্রীমঙ্গলে। পাশের রুমেও ট্রেনিং চলছিল। পার্টিসিপেন্টদের কাজ দিয়ে রুম থেকে একটু বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে অন্য রুমগুলোতে উঁকি দিয়ে দেখছিলাম – বিভিন্ন ট্রেনিং।
দেখলাম মেয়েদেরকে পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলা শেখানো হচ্ছে। যাতে করে তারা যার যার গ্রামে ফিরে গিয়ে এই স্কিল ব্যবহার করে উপার্জন করতে পারে। আরেকটি ক্লাসে গিয়ে দেখলাম,পুরুষ ও মহিলাদেরকে জমির মাপ কিভাবে নিতে হয়, তা দেখানো হচ্ছে। তারা হয়তো এটা শিখে আমিন হিসেবে কাজ পাবে।
পরের রুমে ব্যাংকের অফিসারদের ট্রেনিং চলছে। অন্য এক দিনের কথা- মানিকগঞ্জ ব্র্যাক রিজিওনাল অফিস থেকে একজন তরুণী কাজে যাচ্ছে। জানতে চাইলাম : কী কাজ? সে বললো, ব্র্যাক স্কুলের জন্য এক বাচ্চার নাম রেজিষ্ট্রি করতে হবে। তার মায়ের সাথে নাকি আগেই কথা হয়েছে। বাচ্চার বয়স জানতে চাইলাম। বলল, কিছুদিন আগে নাকি ভূমিষ্ঠ হয়েছে! এরকম অসংখ্য প্রজেক্ট, ট্রেনিং,পরিকল্পনা বহু বছর ধরে চলে আসছে ব্র্যাকে।
ঢাকা থেকে বা খাঁচা থেকে বের হয়ে যখন সারা বাংলাদেশে ব্র্যাকের শত শত অফিস দেখলাম, বিশাল সব ট্রেনিং সেন্টার দেখলাম, আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। কই আমরাতো এর কিছুই জানিনা। এন জি ও সম্পর্কে নেতিবাচক কথাই শুনেছি। এদের আসল কাজ নাকি বিদেশ থেকে নানা ছুতোয় ফান্ড নিয়ে আসা। গ্রামের মানুষেরাও তাই মনে করে।
অথচ এদের এইসব বিশাল কর্মযজ্ঞের কথা কেউ বলে না। কোন এক কল্পনার বিপ্লবের কথা বলে সবাই কিন্তু দেশে নীরব বিপ্লবগুলো যে ঘটে যাচ্ছে, সে কথা কেউ বলে না। টিভিতে ‘মাটি ও মানুষ’দেখে মনে হত গ্রামে উন্নয়ন মানে হাঁস মুরগি পালন, মাছের চাষ, ফল, ফসল চাষাবাদ। ব্র্যাকের শত রকম কর্মসূচি সেই ভুল ভেঙ্গে দিল। এতসব কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে!
ফজলে হাসান আবেদ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাজের পরিমাণ দেখে, সংগঠক শব্দটি আমার কাছে বিশাল মাপের কিছু মনে হতো। আজও তাই মনে হয়। ব্র্যাক অফিসগুলোতে আবেদ ভাইয়ের নাম শুনলেই সবাই ভয় পেতো। কেন্দ্রে সায়ীদ স্যারও একদিন বললেন আমি আবেদ ভাইকে বলেছি, আপনার প্রতিষ্ঠানে কিন্তু একটা ভয়ের সংস্কৃতি আছে।
সায়ীদ স্যার মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে কাজ করতে গিয়ে ব্র্যাক অফিসগুলোতে থাকতেন। বলতেন আমরা হচ্ছে কোকিল। আপনাদের মত এত দালান কোঠা নেই। পরের বাসায় থেকেই কাজ করতে হয়। আসলেই তাই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ঢাকার বাইরে তাদের কর্মসূচি সচল রাখত, কোন সংগঠকের বা স্কুলের কোন পড়ে থাকা রুমকে অফিস বানিয়ে। আবেদ ভাইয়ের সাথে তার অফিসে বসে যেদিন আমার প্রথম কথা বলার সুযোগ হয়, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যি তো!
উনি বিনয়ী, মিষ্টভাষী,শান্ত কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল। সায়ীদ স্যার ও আবেদ ভাই দু’জনের একটা মিল আছে, তারা যখন কথা বলেন মুখে তাদের অজান্তেই মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। দু’জনেই রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। দিনের পর দিন নিজের কাজ করে যান নীরবে। তাদের কাছ থেকেই বুঝেছি দেশপ্রেম আসলে কী।
স্যার একদিন বললেন, উনি ফজলে হাসান আবেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন আপনি এত প্রশিক্ষণ দেন কর্মচারীদের, কিন্তু কিছুদিন পরে তো তারা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয় না? উনি বলেছিলেন ক্ষতি হবে কেন? তারা দেশের যেখানেই কাজ করুক না কেন, তা তো বাংলাদেশের কাজেই লাগবে। এই কথা জেনে আমার মাথা নত হয়ে এসেছিল। বুঝতে পারলাম যেন ফজলে হাসান আবেদকে এতদিনে।
এরা আগে তার মাইক্রো ক্রেডিট প্রোগ্রামের নানা সমালোচনা শুনে ও কিছুটা নিজের চোখে দেখে তার প্রতি কিছুটা বিরক্তি ও অভিমান পোষণ করতাম: আবেদ ভাই কি এসব অনিয়মের কথা জানেন না? শুনেছি এই ক্ষুদ্র ঋণ ব্র্যাকেই প্রথম শুরু করে, পরে গ্রামীণ ব্যাংক তা ফিলোসোফাইজ করে।
ফজলে হাসান আবেদ হচ্ছেন আমার কাছে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা। আপনাদের মত মানুষকে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আমার মত ক্ষুদ্র মানুষদের কীইবা করার আছে? আপনার মৃত্যুর পর আপনার দেশটি বিষণ্ণ তবে তারা আপনাকে নিয়ে আজ গর্বিত বিশ্বের কাছে।
লেখক: কবি ও শিক্ষক, মালয়েশিয়া প্রবাসী।