সোমবার২রা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ৬ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রধান উপদেষ্টার একটি উক্তি এবং কিছু কথা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস রাষ্ট্রীয় সফরে এখন জাপানে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “চাকুরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হউন।”

কথাটি তিনি দেশে-বিদেশে সভা-সেমিনারে অসংখ্যবার বলেছেন। দেশের বেকারত্ব অবসানের লক্ষে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাভলম্বী করার অভিপ্রায়ে তিনি ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করে দেশ-বিদেশে বেশ প্রশংসিত হন। দৃষ্টি কেড়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের। বিশ্বের বিভিন্ন নামী-দামি ভার্সিটিতে এ সম্পর্কে লেকচার দিয়ে বেশ সুনামও অর্জন করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা তৈরির প্রয়াস ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বিশ্বে আজ রোল মডেল। তাঁর এ মহতী উদ্যোগের প্রতিদান স্বরূপ তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান শান্তিতে নোবেল পূরষ্কার পান।

স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো গত ৫৪ বছরে এদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুরনো উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে উদ্যোগ নিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা অনেকাংশেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।

দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে একমাত্র গার্মেন্টস সেক্টর ব্যাতিত বিগত সরকারগুলোর বেকারত্ব নিরসনের কোনো উদ্যোগই সত্যিকারার্থে আশানুরূপ আলোর মুখ দেখেনি। ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতা দেখা গেলেও রাস্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এসব উদ্যোক্তারা অনেকাংশে পিছিয়ে আছে।

২০২৪ এর ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইন্টেরিম গভর্মেন্ট এ দেশের বেকারত্ব রোধে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে বেশ কয়েকটি কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবং প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের একান্ত ইচ্ছায় বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথোরিটি (BIDA) কে সচল/কার্যকরি করার লক্ষে আশিক চৌধুরীকে প্রবাস থেকে ডেকে এনে দায়িত্ব প্রধানের মাধ্যমে যুগোপযোগি পদক্ষেপ গ্রহন করলে এদেশের হতাশাগ্রস্থ পুরনো এবং নতুন শিল্পোদ্যোক্তারা নব উদ্যমে আশাবাদী হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদেরকে আকৃষ্ট করার লক্ষে বিডা কর্তৃক তিন দিন ব্যাপী সম্মেলন করার পাশাপাশি আশিক চৌধুরী সাহেবকে বেশ কর্মতৎপর হতে দেখা যাচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দেশে সদাশয় সরকারের এ মহতী উদ্যোগ কতটুকু আলোর মুখ দেখবে তা এখন দেখার বিষয়।

সরকারের এ মহতী উদ্যোগগুলো সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন দফতর/প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু সদ্য পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়া তথা সুবিধা দেয়ার হীন মানসিকতার কারণে তাদেরই প্রেসক্রিপশন মতো নানাবিধ অযৌক্তিক শর্তাবলি এমনভাবে আরোপ করা হয়েছে যে, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্ঠি হওয়া তো দূরের কথা; পুরনো উদ্যোক্তাদের পক্ষেও টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলেও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন বহাল তবিয়তে আছে; তেমনি তাদের পক্ষে কাজ করা সুবিধাভোগী কর্তাব্যাক্তিরাও সরকারের বিভিন্ন দফতর/প্রতিষ্ঠানে এখনও বহাল তবিয়তে ঘাপটি মেরে বসে আছে। এদের বেড়াজাল থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুক্ত করতে না পারলে সরকারের এ মহতী উদ্যোগ আদৌ ফলপ্রসু হবে কিনা এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ঠ সন্দিহান।

আমি একজন মুদ্রণ উদ্যোক্তা। আমার মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। আমার মতো এ ধরনের মুদ্রণ শিল্পোদ্যোক্তা এদেশে কয়েক হাজার বিদ্যমান। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মদ্রণকার্যের উপর ভিত্তি করে এ ধরণের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও একটি মাফিয়া চক্রের একান্ত হস্তক্ষেপে পুরো মুদ্রণকার্যকে একটি বিশেষ শ্রেণির পক্ষে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক কঠিন কঠিন শর্তারোপের কারণে শীট মেশিন সম্বলিত এসব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ২০২৩ ও ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে দরপত্রে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কঠিন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিল।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান ন্যুনতম অভিজ্ঞতার আলোকে এনসিটিবি’র মুদ্রণ দরপত্রে অংশগ্রহন করে কার্যাদেশ পাওয়ার পর সফলভাবে কার্য সম্পাদন করে সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আসছিল।

২০২৪ এর ৫ আগস্টের বিপ্লবের ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে শীট মেশিন সম্বলিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এনসিটিবি’র বর্তমান দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তার একান্ত ইচ্ছা এবং তৎপরতায় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে এ ধরনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কয়েকটি শর্ত শিথিল সাপেক্ষে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ফলে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন এবং কার্যাদেশ প্রাপ্তির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে পূর্বের ন্যায় চাঞ্চল্য ফিরে আসে।

এসব প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ঠ সময়ের পূর্বে মানসম্মত কাগজে মানসম্মত মুদ্রণ করে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের প্রতিদানস্বরূপ শিক্ষামন্ত্রনালয় কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়। এমনকি পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ থেকে আরও অধিকতর সুযোগ প্রদানের আশ্বাস প্রদান করা হয়।

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য এনসিটিবি’র বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের টেন্ডার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, অতীতের চেয়ে আরও বেশি এবং কঠিন কঠিন শর্তারোপ করা হয়েছে। যার ফলে শীট মেশিন সম্বলিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনের ক্ষেত্রে সুযোগ রাখার কথা বলা হলেও তাদের সক্ষমতার আলোকে শর্ত নির্ধারণ না করায় তা রীতিমতো হাস্যকর হয়ে পড়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বাস্তবিকার্থে অংশগ্রহনের সুযোগ না থাকায় কর্মশূন্য হওয়ার পরিণামে শীট মেশিন সম্বলিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিক ও এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর জীবন ও জীবিকা আজ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

যেখানে বর্তমান সদাশয় সরকার পুরনো উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সহায়তামূলক পদক্ষেপসহ নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে- সরকারী প্রতিষ্টানসমূহকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশনা দিচ্ছে; কর্মসংস্থানের বাজার খোঁজার জন্য সরকার দেশে দেশে ধর্ণা দিচ্ছ; সেখানে এনসিটিবি’র মতো একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান কাদের ইন্ধনে এবং কোন স্বার্থে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া তো দূরের কথা; এনসিটিবি’র পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বিদ্যমান শীট মেশিন সম্বলিত মুদ্রণ উদ্যোক্তাদের চূড়ান্তভাবে গলা টিপে হত্যা করার প্রক্রিয়ায় সায় দিচ্ছে — সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের আজ তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।

Note: আমার উপরিউক্ত লেখাটি কোনো ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়; বরং শীট মেশিন সম্বলিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানসমূহ বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে এবং বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে।

লেখক :-   আলাউদ্দিন গাজী