বাংলা সংবাদ২৪ ডেস্ক– ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের পিয়ন ইয়াছিন মিয়া অফিস নিরীক্ষায় -কোটি টাকার ঘাপলা’র অভিযোগ ওঠার পর গত পাঁচ দিন নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি প্রায় ২৩ বছর আগে সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে পিয়ন পদে নিয়োগ পান। নানা সময়ে আশুগঞ্জ ও নাসিরনগরে বদলি হলেও ঘুরেফিরে তিনি সদর উপজেলাতে ফিরে আসেন।
অভিযোগ রয়েছে, পিয়নের চাকরি করেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। জেলা শহরে রয়েছে তার তিন বাড়ি, সঙ্গে রয়েছে তিন স্ত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইয়াছিন মিয়ার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মরিচাকান্দি ইউনিয়নের আতুয়াকান্দি এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মোহন মিয়ার ছেলে।
তিনি বদলি হয়েছেন নাসিরনগর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ডেপুটেশনে সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কর্মরত। তিনটি ফ্ল্যাট-বাড়িসহ নামে বেনামে রয়েছে আরও অনেক সম্পত্তি।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রায় সময়ই অফিসের নকল, তল্লাশি ও রেজিস্ট্রেশন ফিসহ চালানের টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দিতে পাঠানো হতো ইয়াছিনকে। কিছুদিন আগে অফিসিয়াল অডিটে তার বিরুদ্ধে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রকাশ পায়। এরপর গা-ঢাকা দেন ইয়াছিন। ব্যাংকের ভুয়া চালান তৈরি করে তিনি ওই টাকা আত্মসাৎ করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ভাদুঘর গ্রামের বাসিন্দা ইয়াছিন হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দলিল লেখকরা তাকে সমীহ করে চলতেন। ভাবটা ছিল ইয়াছিনই অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। গত মঙ্গলবার থেকে অফিসটিতে অডিট কার্যক্রম শুরু হলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে। এরপর ইয়াছিন মিয়া পালালেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
অফিসের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার থেকে মিতেন্দ্র নাথ শিকদার নামে অডিট অফিসার অফিসের অডিট কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় সোনালী ব্যাংকের চালান কপিগুলো অসংলগ্ন মনে হলে তিনি গত বুধবার সকালে সাব-রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমানকে ডেকে অফিসে থাকা চালানের কপিগুলো ব্যাংকে গিয়ে মিলিয়ে দেখার পরামর্শ দেন।
সাব-রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান ব্যাংকে গিয়ে চালান কপিগুলো মিলিয়ে জানতে পারেন ব্যাংকে অনেক চালান জমা দেওয়া হয়নি। পিয়ন ইয়াছিন সোনালী ব্যাংকের চালান কপিগুলোতে ভুয়া সিলমোহর ও স্বাক্ষর করে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সোনালী ব্যাংকের ভলিয়মে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের জমা দেওয়া সব চালানের টাকা জমা হয়নি।
পরে মোস্তাফিজুর রহমান অফিসে এসে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ইয়াছিন অফিস থেকে কৌশলে সটকে পড়েন। এরপর থেকে তিনি পলাতক। তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনও বন্ধ। ইয়াছিন পালিয়ে যাওয়ার পর অফিস কর্তৃপক্ষ তার স্বজনদের গত বৃহস্পতিবার অফিসে এনে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের একজন কর্মচারী জানান, তদন্তে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে অফিস ধারণা করছে ইয়াছিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তদন্ত শেষে জানা যাবে কী পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে।
ইয়াছিনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গত ২৯ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে, আরও তদন্ত চলবে।
পিয়ন ইয়াছিন মিয়া সোনালী ব্যাংকের ভুয়া চালান কপির মাধ্যমে সরকারি বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। প্রতি মাসে ব্যাংকের হিসাব বিবরণীর সঙ্গে অফিসের জমাকৃত চালানকপি মিলিয়ে দেখার বাধ্যবাধকতা আছে কি না– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইয়াছিন ভুয়া হিসাব বিবরণীও তৈরি করেছেন। চাকরিকালে তার হাতে সোনালী ব্যাংকে জমা দেওয়া সব চালানকপি পরীক্ষা করে দেখা হবে।
ইয়াছিন নিখোঁজ হওয়ার পর তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। ইয়াছিনের প্রথম স্ত্রী সাজেদা বেগম জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে ইয়াছিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর দুই বছর পর তিনি (ইয়াছিন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে পিয়ন পদে চাকরি নেন। এরপর পৌর এলাকার ভাদুঘরে চার শতাংশ জায়গার ওপর সাজেদাকে একটি তিনতলা বাড়ি তৈরি করে দেন। কয়েক মাস আগে বড় ছেলেকে পাঠিয়েছেন ফ্রান্সে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাজেদাকে বিয়ে করার ১০ বছর পর আকলিমা নামে এক বিধবাকে মেয়েসহ বিয়ে করেন ইয়াছিন। ওই মেয়ে বড় হওয়ার পর তাকে এক ইতালি প্রবাসীর কাছে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই মেয়ের স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে জেলা শহরের পাইকপাড়ায় একটি ছয়তলা বাড়ি করেছেন।
আকলিমাকে বিয়ের পাঁচ বছর পর আরেক প্রবাসীর স্ত্রী মকসুরা বেগমের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে তাকেও বিয়ে করেন। মকসুরাকে নিয়ে শহরের মুন্সেফপাড়া এলাকায় নিজের কেনা একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন ইয়াছিন। সম্প্রতি অফিসের টাকা আত্মসাৎসহ দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশের পর মকসুরাকে নিয়েই গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
ইয়াছিন গা-ঢাকা দেওয়ায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বাবা মোহন মিয়া জানান, ইয়াছিনের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। সে তিনটি বিয়ে করেছে বলে জানি।