শুক্রবার২৪শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি১০ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নামে “বাস্তুহারা” বাস্তবে “কোটিপতি”

বাংলা সংবাদ২৪ সংবাদদাতা– চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত জসিমউদ্দিন ওরফে বাস্তুহারা জসিম নদী দখলের প্রতিযোগিতায় সবাইকে যেন হার মানিয়েছেন । নামে বাস্তুহারা হলেও বাস্তবে তিনি কোটিপতি। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী তীরের বিশাল এলাকাজুড়ে সরকারি খাসজমি দখল করে একসময় গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব এক সাম্রাজ্য। নিজে বনে গিয়েছিলেন বাস্তুহারা সমিতির সভাপতি।

দখল করা নদীর জমিতে প্লট বানিয়ে তা বিক্রি করেন সমিতির কয়েকশ সদস্যের কাছে। আর দখল করা জায়গার বৈধতা দিতে সেখানে গড়ে তোলেন মসজিদ, মন্দির ও বিদ্যালয়ের মতো নানা স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। এ পদ্ধতিতে জসিম হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। ওই টাকায় চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনে গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় দুই যুগ আগে মিয়ানমার থেকে এসে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বসবাস শুরু করেন জসিম।

সেখান থেকে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ২০০২ সালে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় একটি স’ মিলে কাজ শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর সেখানে কাজ করেন তিনি। ২০০৫ সালের দিকে তিনি নগরীর বাকলিয়া খেতচর এলাকায় বাস্তুহারা বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্য হিসেবে নাম লেখান। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সমিতির সদস্যদের মধ্যে নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে জসিম ওই সমিতির সভাপতি পদটিও বাগিয়ে নেন।

বাস্তুহারা বহুমুখী সমবায় সমিতির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সভাপতি হওয়ার পর নিজস্ব একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন জসিম। আর ওই বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে নগরীর শাহ আমানত সেতুর উত্তর পাশে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী বিশাল জায়গা দখল করে নেন। এর মধ্যে আগে থেকে বিভিন্ন জনের দখলের থাকা জমিও জোর খাটিয়ে নিজের কব্জায় নেন জসিম। এ নিয়ে একাধিকবার সংঘর্ষ ও মামলা-মোকাদ্দমার ঘটনাও ঘটে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তৈরি করা কর্ণফুলীর তীর দখলদারদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাস্তুহারা জসিমের নাম। দখল করা জায়গার বৈধতা দিতে সেখানে গড়ে তোলেন নানা প্রতিষ্ঠান। নিজের নামে সেখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। একই সঙ্গে তৈরি করেন দুটি মসজিদ ও একটি মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। প্রায় ১০০ দোকান তৈরি করে তা ভাড়া দেন বিভিন্নজনের কাছে। এছাড়া দখল করা জায়গায় গড়ে তোলা হয় শুঁটকি পল্লী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ’১৪ সাল পর্যন্ত শাহ আমানত ব্রিজ সংলগ্ন বাস্তুহারা সমবায় সমিতি এলাকায় চলে জসিমের রাজত্ব। উল্লিখিত সময়কালে সমিতির সভাপতি পদে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সাহস পেতেন না কেউই। তাই বরাবরই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন জসিম। তার নিয়ন্ত্রণে পুরো এলাকা পরিণত হয় মাদকের আখড়ায়। সরকারি জায়গা দখল করে তৈরি প্লট বিক্রি ও মাদকের আখড়া থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে অল্প দিনের মধ্যেই বনে যান কোটিপতি।

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৫ নম্বর বকশির হাট ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রার্থী হন জসিমউদ্দিন। নির্বাচনী হলফনামায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় আটটি মামলার তথ্য দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটকেন্দ্র দখলে নিতে নির্বাচনের দিন মারামারিতে লিপ্ত হন জসিম ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হন তিনি।

নির্বাচনে পরাজয় ও গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাস্তুহারা সমবায় সমিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন জসিম। সেখানে দাঁড়িয়ে যায় তার প্রতিপক্ষ গ্রুপ। একসময় দীর্ঘদিনের গড়ে তোলা সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যায় তার। পরিবর্তন আসে বাস্তুহারা সমবায় সমিতির নেতৃত্বে। সেখানে নতুন সভাপতি শামসুল আলম তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে এখন চলছে সমিতির কার্যক্রম।

নগরীর বাকলিয়া থানাধীন কর্ণফুলী তীরবর্তী খেতচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সেখানে জসিমের দখল করা জায়গার পরিমাণ অন্তত ৪০ একর। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বর্তমানে বাস্তুহারা বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতির দায়িত্বে থাকা শামসুল আলম তালুকদারের। তিনি জানান, অন্তত ৮০০ মানুষের কাছে প্লট বিক্রি করেছেন জসিম।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, নদীর জায়গা দখলে করে প্লট বিক্রির মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জসিম। আর এ টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনে বহুতল ভবন তৈরি করেছেন তিনি।

সিএমপির বাকলিয়া থানার ওসি মো. নেজামউদ্দিন  বলেন, ‘বাস্তুহারা জসিমের বিরুদ্ধে মারামারি ও জায়গা দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। একবার তিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। পরে আবার জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তবে প্রায় এক বছর ধরে তিনি এলাকায় নেই।

ফিরিঙ্গিবাজারে জসিমের বহুতল ভবন : নামেই তিনি বাস্তুহারা। কিন্তু ফিরিঙ্গিবাজারের দোভাষ লেনে রয়েছে তার বহুতল ভবন। এখানে আছে তার করাত কলের ব্যবসাও। কোতোয়ালি থানার অদূরে ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় দোভাষ লেনের মুখে এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দেন বাস্তুহারা জসিমের বাড়ি।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের মূল ফটকে লাগানো রয়েছে সিসি ক্যামেরা। ভবনের দোতলায় বসবাস করেন জসিমের স্ত্রী তৈয়বা। অন্য ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে বিভিন্নজনকে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ভবনটি নিজের নামে বলে দাবি করেন জসিমের স্ত্রী। তিনি জানান, জসিম এখন ওই বাসায় থাকেন না। থাকেন মহেশখালীতে আরেক স্ত্রীর সঙ্গে।

জসিমের বক্তব্য :- এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য প্রথমে দুই দফা জসিমের মোবাইল ফোনে কল করে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফোন কেটে দেন। তৃতীয় দফায় ফোন করে সরাসরি কর্ণফুলী তীরের জায়গা দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাস্তুহারা সমিতির সভাপতি থাকাকালে বিভিন্নজনের দখলে থাকা সরকারি জায়গার দখলস্বত্ব কিনে নিয়ে আমি তাতে সমিতির সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।

সেখানে আমি স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ ও মন্দির করে দিয়েছিলাম। দোকানঘর তৈরি করে বিভিন্নজনকে ভাড়া দিয়েছিলাম। এসব ছিল সমিতির আয়ের উৎস। সেখান থেকে আমি কোনো টাকা আয় করিনি। ২০১৫ সালে আমি সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতে এখন যারা দায়িত্বে আছেন তারা সেখানকার সব সম্পদ লুটপাট করে খাচ্ছেন।