মনির হোসেন সজীব||
চিকিৎসা সেবা পাওয়া মানুষের মেীলিক অধিকার। যে দেশের আইনের শাসন বিদ্যমান, সে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অতান্ত ভালো। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাবসায়িক ভাবে বিকশিত হয়েছে, মুনাফা করা যার মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশ থেকে একটা বিরাট সংখ্যক রোগী প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী ভারত, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে যায় এজন্যই। এর ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি হাসপাতালগুলো আয় করে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো মূলধারার চিকিৎসাবিজ্ঞান সারাবিশ্বে একই, সব দেশে একই বই পড়ে সবাই ডাক্তার হয়।
বাংলাদেশে আবার ইংরেজিতে লেখা বই পড়ে ডাক্তার হতে হয়, মাতৃভাষায় নয়। একই বই পড়ে এ দেশে যারা ডক্তার হন, মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না কেন? রোগীরা যেন ঠেকায় পড়ে এ দেশের ডাক্তারের কাছে যায়, পয়সা ও সুযোগ থাকলে মনে হয় সবাই বিদেশ থেকে চিকিৎসা করে আসত। কেন? এই দুরবস্থার জন্য রোগী, না চিকিৎসা ব্যবস্থা, কে দায়ী?
কে দায়ী তা বুঝতে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যকার কয়েকটি গলদ প্রথমেই উল্লেখ করা যায়। সবার আগে বলা প্রয়োজন, আমাদের দেশের ডাক্তাররা রোগীর ভাষায় কথা বলেন না। তাদের কথা বলার নিজস্ব ভাষা আছে। তারা অনেকেই রোগীদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দেন, আর প্রেসক্রিপশন লেখেন যে ইংরেজি অক্ষরে তা বোঝার সাধ্য ইংরেজের বাপেরও নেই।
চিকিৎসকের কাছাকাছি দোকানের ওষুধ বিক্রেতা ছাড়া সাধারণত কেউ তা বোঝে না। স্পষ্টতই ডাক্তারের সবচেয়ে কাছের মানুষ ওষুধ বিক্রেতা। ওষুধ বিক্রেতার কাজ ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা। বোঝাই যাচ্ছে, ওষুধ বিক্রেতাকে মাঝখানে রেখে আমাদের দেশের বিরাট সংখ্যক ডাক্তার এই কাজটাই করেন। এ হচ্ছে সরল অঙ্কের হিসাব, একটু খতিয়ে দেখলেও ব্যাপারটা তাই দেখা যায়।
অবশ্য সমস্যাটা বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার একার নয়। সংকটটা মূলধারার চিকিৎসাব্যবস্থার গোড়ায়, তাই অন্য দেশেও কমবেশি বিদ্যমান। সাস্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পার্দু ফার্মা এলপির কথা উল্লেখ করা যায়। এই ওষুধ কোম্পানির তৈরি অক্সি-কনটিন নামের ওপিয়ড অনেক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এ জন্য ২০০৭ সালে পার্দু ও তার তিন কর্মকর্তাকে ৬৩৪০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হয়। এই ক্ষতিকারক ওষুধটি বিক্রি করে তারা আয় করেছে ৩১০০ কোটি ডলার। আসলে অন্যান্য ওষুধ কোম্পানি থেকে পার্দু তেমন আলাদা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়ো-এথিকসের অধ্যাপক পিটার সিঙ্গার ৬ ফেব্রুয়ারি একটি লেখায় পার্দু ফার্মার এসব অপকর্ম সম্পর্কে বলেছেন। অক্সি-কনটিনের ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। ওষুধের প্রচারণার অনেক সূত্র গোপন কৌশল আছে। তার বিক্রয়কর্মীরা সভা-সম্মেলনের নামে ডাক্তারদের আকর্ষণীয় স্থানসমূহে বেড়াতে নিয়ে যেত। আলোচক হিসেবে তাদের সম্মানী দেয়ার নামে ঘুষ দেয়া হতো। বিক্রয়কর্মীরা যে যে ডাক্তারের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের নাম দেখে তাদের কমিশন দেয়া হতো। ভালো বিক্রয়কর্মীর বোনাস ২ হাজার ডলারের উপরে হয়েছে।
আমাদের দেশে অবস্থা এর চেয়ে খারাপ। একটা ব্যক্তিগত ঘটনা বলি। একবার এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে আমি বের হলাম। কয়েকজন রিপ্রেজেন্টেটিভ এসে আমাকে ঘিরে ধরল। এমন ঘটনা যে প্রায় সময়ই হয়,এবং প্রায় প্রত্যেক রোগীর সাথেই হয়, তা সবাই জানেন। তারা প্রত্যেকে আমার প্রেসক্রিশন দেখতে চান ও মোবাইলে ছবি তুলতে চান। আমি দিতে চাচ্ছিলাম না। একজন খুব বেশি কাতর হয়ে বিনিত ভাবে অনুরোধ করছিলেন।
আমি তাদের একজনকে বললাম, কেন আপনাকে এই প্রেসক্রিপশন দেখাব, বলেন। আপনারাই আমাদের রোগীদের সমস্যা। কারণ ডাক্তার তো আমার রোগ সারানোর জন্য ওষুধ লেখে নাই, লিখেছে আপনার বলে দেয়া ওষুধগুলো। ওষুধ লিখেছে আপনার জন্য, আমার জন্য নয়।আপনি এখানে না থাকলে এত গুলো ঔষধ লিখতো না।
অনেক ডাক্তারের ভূমিকা থেকে তাদের ওষুধ বিক্রেতার চেয়ে বেশি কিছু ভাবা যায় না। শুধু তারা ক্ষমতায় একটু বেশি। ওষুধের দোকানের একজন বিক্রয়কর্মী আমি যা চাইব, তাই দিবে, বেশি বা কম নয়। কিন্তু ডাক্তাররা রোগীকে দিয়ে তাদের পছন্দমতো ওষুধ কিনতে বাধ্য করবে। কেননা একজন ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় অসহায় থাকে ও ডাক্তারকে সে বিশ্বাস করে। অনেক চিকিৎসকই রোগীর এই পবিত্র বিশ্বাসকে টাকা উপার্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের নাম লিখে, এমনকি অপারেশনও করে।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ও আন্তর্জাতিক সংগঠন দি ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে এক সেমিনারের আলোচক ডাক্তার এইচ এম লেলিন চৌধুরী নিজেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যৃতি দিয়ে বলেন- ঔষুধ কোম্পানির প্ররোচনায় বাংলাদেশের চিকিৎসকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখেন।
দেশের চিকিৎসায় ৫০% ওষুধই অপ্রয়োজনে প্রয়োগ করা হয়। যা রোগীকে বিভিন্নভাবে আরো অসুস্থ করে তুলছে।তিনি আরো বলেন দেশের রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে কোনো প্রকার নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে না। সকল ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে। উন্নত বিশ্বে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর হার চতুর্থ স্থান অধিকার করে আছে।
আমাদের দেশের চিকিৎসায় অবস্থা ভালো হওয়ার কোনো কারণ দেখি না,বরং দিন দিন খারাপ হতে পারে। ডাক্তার তুমি কার- প্রশ্নটির উত্তর তাই জরুরি। শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারের বিষয়সমূহে ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচার বন্ধ করে সুষ্ঠ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হতে হবে মুখ্য। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দরকার। এবং ডাক্তারদের নৈতিক শিক্ষা অতান্ত্য জরুরী।